শনিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৭

এক হাসিনা থী


অর্ধমৃত ঊর্মিমালার দেহটা
দুর্গম পাহাড়ি গুহায় ছুঁড়েছিলো বিশ্বাসঘাতক প্রেমিক ...
ধেড়ে ইঁদুর , বাদুড়-ডানা ঝটপট
কাঁকড়াবিছে সঙ্গে দু'তিনটে জাতিসাপ

পাথর চাপায় রুখেছিলো একমাত্র প্রবেশ পথ

পিঁপড়ের মহাভোজে
জমাট কালো রক্তাক্ত যৌবন
দেয়াল ফোকরে মাকড়সার আঠালো উঠানামা
জাল বোনা , ঝুলে থাকা
সরু ফাটলে চিলতে আলো
কখনো তেজী কখনো স্নিগ্ধ

দেহটা বেঁচেছিলো ঘেঁয়ো কুকুরের মতো
যৌনাঙ্গে পচে যাওয়া ঘা নিয়েও
ঊর্মিমালার ঘিনঘিনে বেঁচে ওঠা ...

অগুন্তি অন্ধ অন্ধকারে
কতবার চিলতে তেজী আলো ডেকে গেলো
কতবার স্নিগ্ধতা আদর বুলিয়ে গেলো
জমাট কষা নোনাজলে গলাভেজা
গলা চেরা বমি
পিঁপড়ে মিছিলে হামাগুড়ি পাথুরে মন --
সেও এক অনন্য ঊর্মিমালা
আলো পথে উদার স্নিগ্ধ কেউ
বেঁচে থাকা কথা বলে
বেঁচে যাওয়া কথা বলে

কালশিটে চোখের কোল
লতপত পায়ে আদিম গুহামানবী
মানুষে পশুতে খুবলানো ভ্যাম্পায়ার  ঊর্মিমালা ...

মাঝে মাঝে আজব কিছু হয়
তবে তাই হোক ----

বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকটি
মৃত্যু প্ৰহর গুনে
খোলা চোখে দেখে হাত-পা-মুখ বাঁধা
মানব থেকে আদিমানবে রূপান্তর
ধেড়ে ইঁদুর মাকড়সা বাদুড় কাঁকড়াবিছে
আর দু'তিনটে জাতিসাপ

প্রেমিকের শেষ ভুলটা শুধরে নেয় ঊর্মিমালা
সরু ফাটলে পাথর গুঁজে গুঁজে বন্ধ করে আলোপথ

দুর্গম পাহাড় চূড়ায় উল্লসিত ঊর্মিমালা
হিমালয় বুকে বরফ কঠিন আস্তরণে
কোনো টেথিস ঊর্মিমালা
পায়ের তলায় কঠিন লাভা মাড়িয়ে
কোনো বিসুভিয়াস ঊর্মিমালা

"এক হাসিনা থী ..."

     


সোমবার, ২৯ মে, ২০১৭

মুই তর মিয়া আছি

রূপনগর সংবাদ ---- ৪৭
-------------------------------

ঐ বাপ ----
মুই পাস দিলুম গ

তুহার হাতে হাতেখড়ি
অ আ ক খ -- তুই সিখালি
বাগানবাড়ির অঙ্গনওয়াড়ী
আঙুল ধরে তুই ত নিলি

ছকাল হলেই পান্তা ভাতে
সামাই কলা , খেজুর লালি
আদর ঢেলে কালাই থালে
গরাস করে তুই খাওয়ালি

নিজে খেলি মরিচ পুড়ে
মাই কে দিলি আধেকটা
মকাই রোটি ঠুঙায় পুরে
সাজাই দিলি 'টিফিনটা'

ভুখা পেটে জন খাটিলি
মাই ত করল বাবুর কাম
সান্ঝের বাতি জ্বলল যখন
পাইলি না তুর ঘামের দাম

কুপিবাতির আলোয় বইসে
পুঁথির পাতায় দিখাইতিস
লছমী বাই এর তলোয়ারের
ধার হামাকে বুঝাইতিস।

চিনাইছিলিস দয়ার সাগর ,
কবিগুরু , রামমোহন
তুর চুখেতে দেইখেছিলুম
তুহার বুকের বেজান জ্বলন

চিনাইছিলিস ই পিত্থিবীর
দুইটা জাতির মুনিষ সব
মালিক দলের অনেক আছে
ভুখার দলে মজুর সব

লিখা পড়ায় কম ত ছিলিস
হিসাব কিতাব বুঝিস লাই
তাই ত শপথ লিয়েছিলিস
ভুখার পেটে অন্ন চাই

মুই কে যতন কইরে ছিলিস
সপন ছিলস মন-উদাস
মিয়া হবেই লিখা পড়ায়
বি এ এম এ সবটা পাস

বারো বছর হাজার-বারো
বেজান দুঃখ ডাক দিল
বুকের খাঁচায় লাল সুরুজের
লক্ষ পিদিম জ্বলছিল

ঐ বাপ
ইবার কান্দিস কিনে ---

বারোটা ক্লাস পাস ত দিলুম
ইবার কলিজ যাবক লাই ?
দিদিমুনি হবক যে মুই
বুলছি হামি , চিন্তা নাই

আরও বড় পাস ত দিবে
তুহার বিটির লুহার জান
ভুখা পেটের দিন ফুরাবে
রাখবে বিটি তুহার মান।।

         -----------///-----------

Dedicated to my daughter , Aproditi Acharya

মধুমিতা নাথ
28/05/2

রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭

কবির কলমে

কবির কলমে



কবিকে হুমকি দিয়েছিস গণ-ধর্ষণের !!
হাজারো কলম গর্জে উঠুক
                   হাজারো কবিতা বর্ষণের ---

এক কলমেই ঘায়েল হয়ে ফোঁস করিস !!
বিশ্ব-জোড়া কবির আসন ,
                   ক'টা কলমের খোঁজ রাখিস ----

এতো নয় কোন নতুন আঘাত জানিস সবই !!
ইতিহাস জানে , কতটা রক্ত
                    নীরবে ঢেলেছে মানুষের কবি ---

তরবারি থেকে বেয়নেট হয়ে হানলি শূল !!
রক্তলেখায় কবিতা হয়েছে ,
                  "দিতে হবে তোকে ভুলের মাশুল" ----

রাতের আঁধারে বাক্স-খেলার ভোলবদল !!
কবির কলমে ভোরের সূর্য ,
                    ভয় পেয়ে গেলি  নেকড়ের দল ----

তোদের পেছনে স্বার্থান্বেষী গুটিকয়েক !!
কবির সঙ্গে আম-জনতা
                  কবিতার কথা বুঝে তো দেখ ----

তলোয়ার আর বারুদ কেবল জমিয়েছিস !!
তুলি-কলমের শাণিত আঘাতে
                   তোদের মৃত্যু জেনে রাখিস ।।

                    --------------------------

মধুমিতা নাথ

বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭

অসময়

অসময়


ঐ বাপ -----
নাহি সুনলি বটেক
ইত্তবার কইরে তুকে চিল্লা চিল্লা কে ডেইকেছিলুম
নিসুত খাঁ খাঁ মাঠের বুড়া বটগাছটায় পক্ষীগুলান ঝটপটাইছিলস মুর মত ----
হাত পাওগুলান ইক সময় অসার হই গেলস ...

ঐ বাপ -----
তু মুকে ইত্ত নাজুক কিনে বানাইছিলিস !
গতরে তুর মতো মর্দাঙ্গি নাহি দিলিস ,
জনম দিলি , বেইচে থাকার জুর নাহি দিলি গ ...

ভাইকে ভইষের দুধ পিলাইছিস ,
ফুটবল খিলাইছিস , কুস্তি আখড়ায় পঠাইছিলিস ...
মুর লাগি তুর ঘরে দুধ নাহি ছিলস !
মুই ফুটবল খেলতে চেইয়েছিলুম ,
কুস্তি ভি লড়তে সাধ ছিলস গ
নাহি দিলি বটেক , বুললি ----
"ইটা মাইয়া মাইনষের কাম নাহি আছে" ....

ঐ বাপ ----
তু মুকে বেটা বুইলেছিলিস ,
লেকিন বেটা নাহি বানাইছিলিস !
ভগবান ভি মুকে বিটি বনাইল
তু ভি মুকে বিটি বনাইয়ে রাখলি গ ...

ঐ বাপ -----
তু জানিস ন
বিটি হওয়া বড় দুখ আছে রে
ই হমার গতর আজ হমার শত্তুর হইল বটেক !
তু নাহি দেখলি , তুর বিটির চুখে জল নাহি ছিল ,
আগুন ছিল রে ----- আগুন !
কত্ত খুন ঝইরে গেলো ,
দাগ আভি ভি নাহি মিলাইল ...

ঐ শকুনটা যখন বুকের মাংস খুবলেছিলস ,
মুই কান্দি নাই
মুর বুকে বাতাস আটকে ছিলস
শেষবার তুকেই ডেইকেছিলুম

ঐ বাপ ------
কিনে নাহি সুনলি ,
মুই কি দূষ কইরেছিলুম !
শুধু ত ভালো বেইসেছিলুম , ভরোসা কইরেছিলুম ...
যেমন তুকে কইরেছিলুম
মুই নাহি বুইঝেছিলুম রে
ঐ শয়তানটার মর্দাঙ্গিতে কুনু দরদ নাহি ছিল !
কিবল বিষ ছিলস গ ---- বিষ ...

ঐ বাপ -----
মুর নিথর গালে ইকবার তুর আদর বুলাই দে
তুর শেষ আদর ,
আর ছকল বাপগুলানরে বুইলে দে ----
"বিটিয়া কো ভি মরদ জেইসে বনাও , মুকাবিলা সিখাও ,
লড়তে সিখাও , বেঘোরে মরতে নাহি , বাঁচতে সিখাও ..."।।

                 ----------------//-----------------

উৎসর্গ : আমার শহর ধর্মনগর কে ----

মধুমিতা নাথ
29/03/2017

সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০১৭

কুমেরু বসন্ত

পৃথিবীর কোনো প্রান্তে এক কুমেরু
সুষুম্নাকাণ্ডে প্রবাহিত নীল স্রোত
গভীরতর নীল সঙ্গমে ,

কঠিন স্বচ্ছ সাদা মাঠে নিঃশব্দ খুঁজে
কালির আঁচড় কাটা অংকুরিত কবিতা-গাছ ,
মধ্যরাতে ----
ভ্যানগগ্ সূর্যমুখীর সূর্যোদয় বিলাপ আহত বাতাসে
বসন্ত ব্যস্ততায় নাইটিংগেল কোকিলেরা
অন্য মেরু-মরু জুড়ে

রেসের ঘোড়ার খুরে খুরে অতীত
ধূসর চোখে শুধু বিনীত নিঃশব্দ জেদ।
আত্মসর্বস্ব চটুল যৌবন একদিন
মনে মনে অসংখ্য উপকার করেছিলো পৃথিবীর

অদ্ভুত মানবিক বিশৃঙ্খলার মাকড়সা জালে তুমি
জানতেই না
কুমেরু জয়ে কতটা কঠিন হৃদয় চাই ---

হাজারো হিমস্নান সেরে
থেকে যেতে পারো অবিকল অবয়বে
স্পন্দনহীন বদ্ধ নিঃশ্বাসে ---
চিরন্তন চেতন ফসিল।।

       -----////----
মধুমিতা নাথ

রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭

প্রসব



ঘুমন্ত শহরের মধ্যরাতে ব্যথার তীব্রতা বাড়ে
থেকে থেকে ক্লান্ত ঝিমুনি
পূর্ণ গর্ভবতীর মতো ,
কতো 'ডেল' ব্যথা হলে মুক্তি মেলে ডক্টর ?

যন্ত্রণায় কুঁচকে যাওয়া চোখের কোণে বাষ্প জমে
দলা পাকানো কষ্ট আটকে দেয় অনুচ্চারিত শব্দ
মন আর মননের দ্বান্দ্বিক লড়াই ,
লড়াই চলে ----
অনাগত সকাল যে চাই

তুমি তো শল্য-পারদর্শী , ডক্টর !
তোমার শান-ঘষা ছুরি-কাঁচির ধারটুকু আমায় ধার দেবে ?
হেসো না ডক্টর ---
তোমার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কিছুই আমি দেখবনা এখন

জানি ---- এ স্বপ্ন তোমার নয়
            এ কথাও তোমার নয়
ব্যথা-সুখ-রাগ-অনুরাগ কিছুই তোমার নয়
তাই কষ্টটুকুও তোমার নয়।
তবুও কেবল তোমারই হাতে মুক্তি অপেক্ষায় ---
রাতভোর সয়ে যাওয়া ,
ব'য়ে যাওয়া ব্যথার বিসুভিয়াস

তারও পর ---
শিশু-সূর্য যখন চোখ মেলে
আলোকিত শল্য-আগার
ছুরির ফলায় নাচে রক্ত মাতন ,
ছুঁচ ফোটানো কষ্টেরাও
কান্না ভুলে থাকে আপাতত

তোমার এই নিষ্ঠুরতাটুকু
আমার সৃষ্টির তাগিদেই ডক্টর !
আমার মাতৃত্বেই তোমার অহংকার ---
তোমারই প্রথম স্পর্শ-ধন্য
আমার আত্মজ ---- কবিতা !!
         ---------//----------
মধুমিতা নাথ

শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০১৭

রেজারেকশন

                                                    RESURRECTION
                                                -------------------------
                                                  Madhumita Nath


                            TRANSLATED BY Parthapratim Acharya
                        from original Bengali poem ( রেজারেকশন্ ) by Madhumita Nath


                     The stony soil is unfurled.
                     Love ‘s resurrection!
                     Even the lovelorn
                      yearning of the cuckoo
                      Through its tearing throat
                        Mingled with the ether, echoing , resonating.
                        Floating in the abyss of time
                        Strong, skilled spark
                        Of the beeping radar in brain
                        Let loose in bleeding song.
                        Shuddering of the heart…
                        Trajectory?-RUPNAGAR.
                        Rainbow, sensational droplets
                        From the sky, a dreamy flight!
                        Light pressure of fingers
                       Creates the playhouse of colourful letters.
                        Arrows of venomous- asking
                        Dazzled- deer-thriving
                        Black and white pictures
                        Become grilled in untimely senility
                       Time and again.
                       Krishnachura –clad spring
                       Plays tarana in the sur saptaka
                       Hush! Listening to the tune of heart…
                       Sweet adoration!
                         Touching the wet lips .Even now the esthesis
                         Of teen-aged outbursts of eternal spring
                         My resurrected love.
                           ----------------//-------------


রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

রূপনগর সংবাদ --- ৩২

।।মধুমিতা নাথ ।।
-------------------------------
অলিন্দ আর নিলয়ের মাঝখানে
বহমান ঝিরঝির ছোট নদী
কিছু রূপ চুপ কথা
রোজ লজ্জাবতী ফুল হয়ে ফোটে
কূজন-মুখরিত উপত্যকা ঢাল গড়িয়ে
বনছায়া কাঁপে তিরতির।

অদৃশ্য হাতছানিতে
পেলব দিনগুলোর অবাক জলপান।
সেদিন শ্রাবণ ঢল ,
যৌবনা স্রোতস্বিনী উথাল পাথাল
নীলাভ অভিযানে বেসামাল বেসামাল
আপন কস্তুরী গন্ধে হরিণী মাতাল।
স্বপ্ন-সেতু-বন্ধন শেষে হেমন্ত নামে , ফসল শূন্য মাঠে অবারিত অপেক্ষা
একবিন্দু সুধা সিঞ্চন আকুলতা
ঝিম-ধরা সময়ে
পুড়ে পুড়ে খাক্ হয় কিছু জ্বলন্ত দুপুর।।
-------------//--------
*ত্রিপুরার রাজন্য আমলের কবি অনংঙ্গ মোহিনী দেবীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
মধুমিতা নাথ

মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

একটি পত্র

 মধুমিতা নাথ

ম্যাম ,
প্রণাম তুমি নিতে চাওনা , জানি। কিভাবে যে শুরু করি ! তুমি ভালো আছো ? জানি বলবে ---" বিন্দাস!"। আমি ভালো নেই। এবার তুমি আমায় একচোট বকুনি দেবে। "উল্লুক" , "মুরগি চোর" , "ন্যাকা চৈতন্য" ...। কতদিন হলো তোমার মিষ্টি বকুনিগুলো খুব মিস করি।

তুমি বলতে --- "সবসময় বলতে হয় ভালো আছি। ভালো থাকাটা একটু কঠিন ঠিকই। সবাই পারে না। আর সবাই যা পারেনা সেটা করতে পারাটাই তো আনন্দের " ।

কি অসম্ভব মনের জোর গো তোমার ! সবসময় হাসিমুখে থাকো কি করে ? তোমার কি কোনো সমস্যাই নেই ! কোন অসুখ বিসুখ ! তোমাকে আমরা বলতাম "IRON LADY" । কি সুন্দর পড়াতে তুমি ! তোমার প্রিয় চরিত্র শরৎ চন্দ্রের 'ইন্দ্রনাথ'। বলতে --- "ইন্দ্রনাথ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে সৃষ্ট এক অদ্ভুত সৃষ্টি"। কি সুন্দর লাইন। এখনো কানে বাজে।কত বলবো আর !

আমাদের নিয়ে ভলিবল খেলতে। টুয়েলভ ক্লাসে পড়ার সময় স্কুলে সে বছর প্রথম আমরা মেয়েরা ভলিবল চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম টিচারদের হারিয়ে দিয়ে। কি দারুণ ভালো লাগা। সেতো তোমার প্রেরণায় , তোমার চেষ্টায়! ! তারপর "ডাকঘর" নাটক ! "চণ্ডালিকা" তে আমাকেই তুমি প্রধান চরিত্রে সিলেক্ট করেছিলে। নাচ শেখালে , গান শেখালে , হাসতে শেখালে , বাঁচতে শেখালে।

যে কারণে তোমায় লিখতে ইচ্ছে হলো। বাঁচতে ভুলে যাচ্ছি। বাবার গলায় টিউমার অপারেশন হয়েছে। বিছানায় শয্যাশায়ী। মা নার্সারী স্কুলের ছোট্ট চাকরীটা এখনও করছেন। দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে সারা গায়ে মার খাওয়ার চিহ্ন নিয়ে। আর যাবে না। আমি অনার্স গ্র্যাজুয়েশন নিয়েছি দু'বছর হলো। এম এ করা আর হলো না। ছোট্ট একটা প্রাইভেট এজেন্সিতে ঢুকেছি। দশটা- পাঁচটা। মাস ফুরোলে সাড়ে নয় হাজার। শহরে একটা মেয়ে একলা থাকার মতো ভাড়াবাড়ি পেতে কতটা কষ্ট  তা জানো। এক হাজার তো বাড়ি ভাড়াই দিতে হয়। নিজের খরচ চালিয়ে বাকিটা মা'কে পাঠাই। একটা ভালো চাকরীর আমার ভীষণ দরকার। একটার পর একটা চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছি। কিচ্ছু হচ্ছে না। সবখানে tough কম্পিটিশন। আমার মতো মধ্য-মেধার ছেলেমেয়েদের যে কি দুরবস্থা জানো ! বাবা বিয়ের কথা ভাবছে। মা রেগে যায়। বলে ---"এক মেয়ে বিয়ে দিয়ে আক্কেল হয় নি ! বহ্নি'র বিয়ে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। ওকেই ভাবতে দিও"।

ম্যাম , আমি কিছুই ভাবতে পারছিনা একটা ভালো চাকরী ছাড়া। morality তো তুমিই বানিয়ে দিয়েছো এমন।  বাবার ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু শরীর , মায়ের কর্মক্লান্ত সংসার , দিদির ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি ---- ওসব দেখতে হয় বলে বাড়ীতে খুব কম যাই । জয়দীপেরও কোন চাকরী হচ্ছে না। তাছাড়া ওরও তো ফ্যামিলি বার্ডেন আছে । সেদিন তুমি আমায় সিরিয়াসলি খুব বকলে। না , ওই মিষ্টি বকুনি নয়। আমি বলেছিলাম শুধু যে ----''মাঝে মাঝে মনে হয় এই দেশটাই আমার নয়। রিজার্ভেশন এর পর আমরা যারা বেশির ভাগ আছি তাদের কথা এই দেশটা কবে ভাববে ? মনে হয় বিদেশে পালাই। গিয়ে রেস্তোরাঁয় কাজ করি। কিংবা পেট্রোল পাম্পে। টাকা তো আসবে ! আমার যেকোন মূল্যে টাকা চাই !"

তুমি আমায় "স্বার্থপর" বললে। "এঁচোরে পাকা" বললে। "ESCAPIST"  বললে।  আরও বললে দেশকে ভালবাসতে শিখিনি। কেন ? কি অন্যায় কথা বলেছি আমি ? কোন কবি যখন বলেন --" এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয় । এ জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ নয় ..." তখন তুমি তা আবৃত্তি করে শোনাও। আবেগে তোমার চোখে জল চিকচিক করে। আর আমার কথায় তোমার আমাকে স্বার্থপর মনে হলো ? কেন ? আমি কবিতা লিখতে পারি না বলে ? পারি না তো ! আমি সোজাসাপ্টা বলি। "পাথরকে পাথর , গাছকে গাছ"।

আমায় ক্ষমা করে দিও। এই প্রথম তোমাকে আমি অভিযুক্ত করলাম। তুমি আসলে আমাকে অভিনয় করে যেতে শিখিয়েছিলে। হাসি না পেলেও হাসবে। ভালো না থাকলেও বলতে হবে ভালো আছি -- "বিন্দাস" । কেন মিথ্যে বলতে শেখালে। তোমার মতো আয়রন হতে পারিনি। আমি দুর্বল। ভাঙছি। রোজ একটু একটু করে।

ভেঙে যেতে যেতেও তোমায় মনে পড়ে। তাই লিখছি। আবার স্কুলের দিনগুলোতে ফিরতে ইচ্ছে করে। যেখানে তোমার হাসিটাকেই সত্যি মনে হতো। তুমি সাহস জোগাতে। "বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা / বিপদে আমি না যেন করি ভয় ..."

তুমি রাগ করো না। মাথার ঠিক নেই। আবোল তাবোল অনেক বললাম। জানি , তুমিই ঠিক। বুঝতে পারছি , কতটা আঘাত সহ্য করলে তোমার মতো সবসময় হাসতে পারা যায়। বাঁচতে পারা যায়। তোমার হাতটা আরেকবার আমার মাথায় রাখো। আমি ভাঙতে চাই না। তোমার মতো "আয়রন" হতে চাই। পাশে থেকো , যেমন এতদিন ছিলে।

                     ইতি ------
                    তোমার একসময়ের সেরা ছাত্রী ,
                               
                                        বহ্নি
03/02/2017

              -------------------//-----------------
* পত্র সাহিত্যের ক্ষুদ্র প্রয়াস

মধুমিতা নাথ
03/02/2017